খাওয়ার টেবিলে বসে ডাঃ মার্টিন লুথার কিং এক সুন্দর ঘটনা ব্যক্ত করেছিলেন : ঘটনাটি তৎকালীন আমেরিকার মন্টগোমেরিতে বাস বয়কট প্রতিবাদ চলাকালীন ঘটেছিল। একদিন গভীর রাতে ডঃ কিং একটি ফোন কল পান – ওপারের কণ্ঠটি ডাঃ কিংকে সবচেয়ে ভয়াবহ পরিণতি অর্থাৎ মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিলেন। অতঃপর, কি ঘটেছিল ডঃ কিংয়ের জবানিতেই শুনুন, “নিজের হাতে মাথা রেখে আমি ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানালাম এবং জোরে জোরে প্রার্থনা করলাম। হঠাৎ আমার শরীরে যেন একটা শিহরণ বয়ে গেল। মনে হচ্ছিল যেন আমি অভ্যন্তরীণ এক কণ্ঠের শান্ত আশ্বাসবাণী শুনতে পাচ্ছি: ‘মার্টিন লুথার, ধর্মের পক্ষে দাঁড়াও, ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াও, সত্যের পক্ষে দাঁড়াও। আর আমার প্রতি বিশ্বাস রেখো। দেখো, আমি ঠিক তোমার সাথে থাকবো। এমনকি পৃথিবীর শেষ অবধি। সেই মুহুর্তে আমি এমন এক ঐশ্বরিক উপস্থিতি অনুভব করলাম যেমনটা আমি আগে কখনো অনুভব করিনি। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আমার মন থেকে ভয় ও দ্বিধা যেতে শুরু করল, আমার সমস্ত অনিশ্চয়তা দূর হলো। আমি তখন যেকোনো কিছুর মুখোমুখি হতে মানসিক বল পেলাম।” তাঁর, “আমার একটা স্বপ্ন আছে (I have a dream) বক্তৃতাটিও কিন্তু তাঁর এই শোনার ক্ষমতার নির্যাস। বক্তৃতাটির প্রায় শেষের দিকে, তিনি একদম সামনের সারিতে বসা মহালিয়া জ্যাকসনের উদাত্ত ডাক শুনতে পেলেন যেন, “তোমার সেই স্বপ্নের কথা সবাইকে বলো মার্টিন! তোমার স্বপ্নের কথা সবাইকে শোনাও,” জ্যাকসন বারবার চিৎকার করে বলছিলেন। তারপর তো ইতিহাস।
উপরের এই ঘটনাটি বলার কারণ কি ?
মানুষের কথা শোনার যে এই প্রবণতা, সহিষ্ণুতা, “আমিই একমাত্র সব জানি” সিন্ড্রোমটি (লক্ষণ) দূরে সরিয়ে রাখতে পেরে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন মতাবলম্বী মানুষের মনের কথা শোনা, তাদের চাওয়া পাওয়ার খবর নেওয়া, সাধ্যমতো সেগুলির সমাধানের জন্য সর্বোত্তম একটি বিকল্প খুঁজে দেওয়া এমনটি আমি সমকালীন রাজনীতিতে একমাত্র রাহুল গান্ধীর মধ্যেই দেখতে পাচ্ছি।
4000 কিলোমিটার তিনি পায়ে হেঁটেছেন, ১৩৬ দিন ট্যাঙ্কারে রাত কাটিয়েছেন, কেন? মাইলের পর মাইল হেঁটে এসে মানুষ তার সাথে পা চালিয়েছেন, তাদের নিজেদের দুঃখ দুর্দশা রাহুলের কাছে উজাড় করে দিয়েছেন, কারণ কেউ তাদের মনের কথা তো শোনে না। যাওয়ার আগে সবাই যে তাদের দুঃখকষ্ট থেকে সমাধানের আশ্বাস নিয়ে ফিরেছেন তা তো নয়। আমরা তো জানি সবার সমস্যার সমাধান করা সহজ হবে না বিশেষ করে যে বিভাজনকারী ও সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে সর্বদা লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে।
কিন্তু, মানুষের সমস্যা শোনাটা হল প্রথম ধাপ, সমস্যাটিকে গুরুত্ব ও স্বীকৃতি দেওয়া ও তার উপযুক্ত সমাধান খোঁজার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হল পরবর্তী ধাপ। দেখে চমৎকৃত হই যখন তিনি জনগণের ভিড়ে মিশে যেতে পারেন, তাদের জন্য নিজের তাঁর হৃদয় ও আত্মা উন্মুক্ত করে দেন। সুরক্ষা সম্বলিত কোনো বিধিনিষেধ তিনি মানেন না, প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে সবাইকে আপন করে নেন, অথচ তাঁর দুই প্রিয়জন কিভাবে প্রাণ হারিয়েছেন তা’ সারা বিশ্ব জানেন।
একটি বৃহত্তর উদ্দেশ্য যেন মানুষটির জীবনটাকে খুঁজে নিয়েছে, নির্ভীক সেই মানুষটি বারবার চ্যালেঞ্জের দিকে এগিয়ে যান, বিপরীতপক্ষ তার উদ্দেশ্যে যাই নিক্ষেপ করুক না কেন। তিনি যেন ভারতের আত্মার সাথে একীভূত হয়েছেন, লীন হয়েছেন। মানুষ তাদের আশা, আকাঙ্ক্ষা সবই তাঁর ধৈর্য্যশীল কানে ফিসফিস করে শুনিয়ে যাচ্ছে, তিনি মনোযোগ সহকারে শুনছেন। মাইলের পর মাইল এই যাত্রা কিন্তু চলতেই থাকবে, দেশের আপামর জনগণ এসে তাকে সমৃদ্ধ করতেই থাকবে। কারণ, তারাও জেনে গেছেন, আর কেউ শুনুক না শুনুক, এই মানুষটি যিনি কোনো দূরের গ্রহের জীব নন, তিনি তাদের কথা ঠিক শুনবেন।
যাত্রা পার্ট ২ শুরু হল বলে!